সড়ক নাকি খাল, নেই বোঝার উপায়

শেয়ার করুনঃ

বৃষ্টি মানেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতা। কিন্তু মেঘের ঘনঘটা না থাকলেও বছরজুড়ে জলাবদ্ধতা, কিছুটা অস্বাভাবিকই বটে। কোথাও থই থই পানি, কোথাও হাঁটুসমান পানি, সেই সঙ্গে পুরো সড়কে অসংখ্য খানাখন্দ। কোথাও ছোট ছোট, আবার কোথাও বড় গর্ত; সঙ্গে কাদাপানি। সবমিলিয়ে সড়কজুড়ে মানুষ মারার ফাঁদ! বোবাকান্না স্থানীয়দের।

দূর থেকে মনে হবে কর্দমাক্ত কোনো খাল। এর মধ্য দিয়েই বড় বড় যানবাহন চলছে হেলেদুলে। সৃষ্টি হচ্ছে ছোট-বড় ঢেউ। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে পথচারীদের ওপর। ভিজে নষ্ট হচ্ছে পরনের জামা-কাপড়। এটা যেন প্রতিদিনের চিত্র।

সড়কের এমন ভয়াবহ চিত্র কোনো গ্রাম বা মফস্বল শহরের নয়, খোদ রাজধানী ঢাকা শহরের। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ডুমনি এলাকার সড়কের চিত্র এটি। ঢাকা উত্তরের সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে এলাকাটি।

স্থানীয়রা জানান, সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার ছোট-বড় যানবাহন চলাচল করে। রাজধানীতে বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, কিছু সময় পর পানি নেমেও যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ডুমনির এ সড়কের বেহাল দশা পিছু ছাড়ছে না এলাকাবাসীর। অধিকাংশ স্থান খানাখন্দে ভরা, সেই খানাখন্দে বৃষ্টির পানি জমে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। রাবিশ ফেলে খানাখন্দ ভরাটের ব্যর্থ চেষ্টা হলেও কর্দমাক্তের ব্যাপকতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিকল্পিত উপায়ে সড়কটির সংস্কারের অভাবে এলাকাবাসীর পথের কাঁটায় পরিণত হয়েছে এটি। ঘটছে দুর্ঘটনাও।

কাদাপানিতে ছেয়ে থাকায় বোঝা যায় না কোথায় কেমন গর্ত। ফলে সামান্যতম অসাবধানতায় উল্টে যাচ্ছে রিকশা, অটোরিকশা। ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ছে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারসহ ভারী যানবাহনের।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ডিএনসিসির বর্ধিত অংশ হিসেবে ওয়ার্ডটি নতুন যুক্ত হলেও ইউনিয়ন পরিষদের সার্বিক চিত্র এখনও বিরাজমান। নেই উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া। এলাকাবাসীর দাবি, দিনদিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। আগে রাস্তা মনে হলেও এখন মনে হবে কর্দমাক্ত কোনো খাল।

সরেজমিন পরিদর্শনে স্থানীয়দের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়ে এই প্রতিবেদককে। তারা বলেন, গ্রামের যেকোনো রাস্তারা চেয়েও এর অবস্থা খারাপ। বলতে কষ্ট হয়, আমরা সিটি করপোরেশনের অধীনে বসবাস করি। ডুমনি এলাকার পিংক সিটি থেকে ডুমনি বাজার, পাতিরা, ইছাপুর পর্যন্ত সড়কের এতই বেহাল দশা যে, হাতে জান নিয়ে চলাচল করতে হয়।

অত্র এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অটোরিকশা চালান ফজলুর রহমান। স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। অটোরিকশা চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন। বলেন, রাস্তার এমন খারাপ অবস্থা যে, রিকশা চালানো তো দূরের কথা, মানুষ পায়ে হেঁটেই চলতে পারে না। প্রায়সময় অটোরিকশা খাদে পড়ে উল্টে যায়, যাত্রীরা আহত হন। রিকশার ক্ষতি হয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় দুর্ঘটনাও।

‘রিকশা চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় যাত্রী পাওয়া যায় না। ফলে আয়-রোজগারের অবস্থাও খারাপ। পাঁচ বছর ধরে এমন পরিস্থিতি। মাঝেমধ্যে রাবিশ ফেলা হয় কিন্তু কোনা কাজ হয় না। উল্টো বৃষ্টি হলে আরও বেশি কর্দমাক্ত হয় সড়কটি।’

পোশাক শ্রমিক মরিয়ম খাতুন, এখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস। প্রতিদিন কাজের তাগিদে পিংক সিটির দিকে যেতে হয় তাকে। কখন যে গর্তে পড়ে পা মচকায়, কখন যে কাদা ছিটে পরনের কাপড়ে নষ্ট হয়— টানা পাঁচ বছর এই চিন্তা নিয়ে রাস্তায় পা ফেলতে হয়। তিনি বলেন, আমাদের দুঃখ কারও চোখে পড়ে না। ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড হলো কিন্তু সুখের ছোঁয়া এখনও মিলল না।

একমাত্র সড়ক হওয়ায় প্রতিদিনই এটা ব্যবহার করতে হয় হায়দার আলীর। ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়েই বাসা থেকে বের হন তিনি। কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, পুরো সড়কটি খানাখন্দে ভরা। কাদাপানিতে একাকার, প্রায়ই গর্তে আটকে যায় গাড়ি। তখন দুর্ভোগের শেষ থাকে না। পায়ে হেঁটে যাব, সেই উপায়ও নেই। মূলত বড় বড় গাড়ি চলাচলের কারণে সড়কটির এই অবস্থা।

স্থানীয় দোকানি সাইদুর রহমান বলেন, রাস্তা খারাপ থাকায় দোকানে কেউ আসে না। ফলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা, সামান্য বৃষ্টি হলেই কাদাপানিতে থৈ থৈ করে। তখন দোকান খুলতেও ইচ্ছা করে না। ভাবছি, অন্য কোথাও চলে যায়। এখানে ব্যবসার কোনো পরিবেশ নেই।

এলাকাবাসীর এমন দুর্ভোগের বিষয়ে কথা হয় ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শরিফুল ইসলাম ভূঁঞার সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সড়কের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নের লক্ষ্যে খুব দ্রুতই কাজ শুরু হবে। রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। কোথায় কেমন রাস্তায় হবে, এসব তালিকা আমরা ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনের কাছে জমা দিয়েছি। আশা করি, আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে কাজ শুরু হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নতুন ওয়ার্ডগুলোতে দৈনন্দিনসহ যাবতীয় সেবার আওতায় আনতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক ও বাজার, রাস্তা ও ফুটপাত নির্মাণ, এলইডি বাতি স্থাপনসহ অনেক অবকাঠামো থাকছে। থাকছে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনাও। পাশাপাশি বছরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উন্নত বিশ্বের মতো ফুটপাতের নিচ দিয়ে সবধরনের ইউটিলিটি সার্ভিসের লাইন বসানো হবে।

নতুন ওয়ার্ডগুলো নিয়ে ডিএনসিসির পরিকল্পনা

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চলতি বাজেটে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক, অবকাঠামো এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ ও উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া সম্প্রসারিত এলাকার জন্য সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা।

মূল প্রকল্পে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের জন্য ১৬১.৭২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন এবং ২২২.৮২ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ ও উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ১১ হাজার ২২৪টি এলইডি লাইট স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে।

সম্প্রতি নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো পরিদর্শনে যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেসময় তিনি বলেন, নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চার হাজার ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প পাস করে দিয়েছেন। এখানকার রাস্তাগুলো চওড়া হবে, ১৩টি খাল আছে, সেগুলোর অনেক জায়গা দখল হয়ে আছে। এই ১৩টি খাল পুনরুদ্ধারসহ উন্নয়ন করা হবে। এতে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। সেই সঙ্গে রাস্তা প্রশস্ত করতে গেলে অনেক স্থাপনা ভাঙা পড়তে পারে। ডিএনসিসির ম্যাপিং অনুযায়ী রাস্তার দুই পাশে যার স্থাপনাই থাকুক না কেন, সেগুলো ভেঙে আমরা রাস্তা প্রশস্ত করব।

এদিকে ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে শহরের ভারবহন ক্ষমতা বিবেচনায় জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, বসবাসযোগ্য ঢাকা গড়তে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। এলাকাভিত্তিক জনঘনত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ডিজাইন পপুলেশন ঠিক করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিতে হবে। তা না হলে সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটিতে (নিকার) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আটটি করে ইউনিয়ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে নবগঠিত ৩৬টি ওয়ার্ডকে দশটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। সেখানে ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের (ডিএনসিসি) অন্তর্ভুক্ত বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, বেরাঈদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়নকে ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘসময় পার হলেও এসব ওয়ার্ডে কার্যত তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।