বিশ্বজুড়ে বর্জনের ডাকে বিপদে ফ্রান্স, ঝুঁকিতে যেসব পণ্য

শেয়ার করুনঃ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কার্টুন প্রদর্শন ও মুসলিমবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফরাসি পণ্য-সামগ্রী বর্জনের ডাক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। পণ্য বর্জনের এই প্রভাব দেশটির অর্থনীতির ওপর কি ধরনের হতে পারে সেটি নির্ধারণ করা এই মুহূর্তে কঠিন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফরাসী পণ্য বর্জনের ডাকের বিক্ষিপ্ত প্রভাব গণমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে।

ফরাসি কিছু প্রতিষ্ঠান এবং খাতের কিছু তালিকা প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিছু দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সামগ্রীর জনপ্রিয়তা আছে। তবে রয়টার্স বলছে, সেগুলোর কোনও কিছুর ওপর বর্জনের প্রভাব এখন পর্যন্ত পড়েছে কিনা তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

শস্য

বিশ্বে শস্যের অন্যতম প্রধান রফতানিকারক দেশ ফ্রান্স। দেশটির কয়েকটি বৃহত্তম বাজার রয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিছু দেশে। ফ্রান্সের খামার মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ফ্রান্সের কৃষিপণ্য রফতানির দশম বৃহত্তম বাজার আলজেরিয়া। গত বছর উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে ফ্রান্স অন্তত ১৪০ কোটি ইউরোর কৃষিপণ্য রফতানি করেছে।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিতর্কিত কার্টুন প্রকাশ করায় ফ্রান্সের নিন্দা জানিয়েছে উত্তর আফ্রিকার আরেক মুসলিম দেশ মরক্কো। এই দেশটিতেও গত বছর ফ্রান্স ৭০০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের কৃষিপণ্য রফতানি করেছে। ফ্রান্সের কৃষিপণ্য রফতানির ১৭তম বৃহত্তম বাজার মরক্কো।

সুপারমার্কেট

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে ফরাসি পণ্য সামগ্রী বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছে। সৌদিতে বর্জনের অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছে ফরাসী সুপারমার্কেট চেইন ক্যারেফোর। ফরাসি এই সুপারমার্কেট চেইনের পণ্য বর্জনের ডাক সৌদি আরবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ড হয়েছে। ভোক্তাদের এই মার্কেটের পণ্য কেনা থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

ফরাসি এই খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অংশীদারদের সঙ্গে ফ্রাঞ্চাইজি ব্যবস্থার ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করছে। মরক্কো, লেবানন, পাকিস্তান, বাহরাইনসহ আরও বেশ কিছু দেশে এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম রয়েছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদকরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের ক্যারেফোরের অন্তত দুটি দোকান পরিদর্শন করেছেন। অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের মতো দোকান দু’টিতে ব্যস্ততা দেখতে পেয়েছেন তারা।

জ্বালানি

ফ্রান্সের জ্বালানি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান টোটাল বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশে উপস্থিত রয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিতর্কিত কার্টুন প্রকাশের জেরে যে কয়েকটি মুসলিম দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, সেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং তুরস্কে টোটালের পেট্রো-কেমিক্যাল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের বড় বাজার রয়েছে।

সৌদি আরবসহ আরব উপসাগরীয় বেশ কয়েকটি দেশে জ্বালানি অনুসন্ধান, উৎপাদন এবং পরিশোধনে টোটালের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।

ফ্যাশন ও বিলাসী পণ্য

রোববার কুয়েতের রাজধানী কুয়েত সিটিতে একটি দোকান পরিদর্শন করেছেন রয়টার্সের প্রতিনিধি। এ সময় তিনি ফরাসী কোম্পানি লরিয়েলের উৎপাদিত প্রসাধনী ও রূপচর্চার বিভিন্ন পণ্য দোকানের তাকে দেখতে পাননি।

দোকানের মালিক বলেছেন, ফরাসি এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য তারা সরিয়ে ফেলছেন। কুয়েতি এই দোকানের অন্তত ৭০টি আউটলেট রয়েছে; দেশটিতে তারা লরিয়েলের পণ্য বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও ফরাসি ফ্যাশন খাতে লরিয়েলের অবদান অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় সীমিত।

এশিয়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রান্সের প্রধান প্রধান ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বাজার খুব বেশি বড় নয়। ফরাসী অন্যতম ব্র্যান্ড এলভিএমএইচের মালিকানায় রয়েছে লুইস ভিটন। এই সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এই ব্র্যান্ডের স্টোর রয়েছে। দেশের বাইরে ভ্রমণে যাওয়ার সময় মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালীদের বিলাসবহুল পণ্যসামগ্রী কেনার প্রবণতা রয়েছে।

প্রতিরক্ষা এবং অস্ত্র

বিশ্বে অন্যতম প্রধান অস্ত্র রফতানিকারক দেশ ফ্রান্স। দেশটির থ্যালেস কোম্পানি বিশ্বের বেশ কিছু মুসলিম দেশে অস্ত্র, অ্যারোনটিকস প্রযুক্তি ও গণপরিবহণ ব্যবস্থার ব্যবসা রয়েছে।

কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক এবং কাতার থ্যালেসের অন্যতম ক্রেতা। থ্যালেসের কাছ থেকে রাফাল সামরিক যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে ডাসল্টও কিনে মিসর ও কাতার; এই অঞ্চলে থ্যালেসের অন্যতম বিশাল দুই বাজার। এছাড়া আরও কিছু দেশ থ্যালেসের ক্রেতা।

গত ১৬ অক্টোবর প্যারিসের উপকণ্ঠে দেশটির এক স্কুল শিক্ষকের শিরশ্ছেদ করে ১৮ বছর বয়সী এক কিশোর। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিতর্কিত কার্টুন শিক্ষার্থীদের প্রদর্শনের কারণে ক্ষুব্ধ ওই কিশোর স্কুল শিক্ষককে হত্যা করেন।

পরে ফ্রান্সের সরকার ওই স্কুল শিক্ষককে দেশটির সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদকে ভূষিত এবং বিভিন্ন ভবনের গায়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিতর্কিত সেই কার্টুনের প্রদর্শন শুরু করে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই কার্টুনের প্রদর্শনের ব্যবস্থার নির্দেশ দেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্টর এই অবস্থানের প্রতিবাদে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের হিড়িক পড়ে গেছে। অনেক খ্যাতনামা চেইন শপসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফরাসি পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাকালে এই বর্জনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আঁচ করতে পেরে আরব দেশগুলোর প্রতি পণ্য বর্জন বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছে ফ্রান্স।

এদিকে, এক বিবৃতিতে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মহানবী (সা.) এর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশের পর সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে ফ্রান্সের পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাকও পড়েছে বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে।

‘বয়কটের এসব আহ্বান ভিত্তিহীন এবং অবিলম্বে এগুলো বন্ধ হওয়া উচিৎ। সেই সঙ্গে সব ধরনের আক্রমণাত্মক মনোভাব, যা একটি উগ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উস্কে দিচ্ছে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে।’

সূত্র: রয়টার্স।