৮ বছরেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক পটুয়াখালীর সাবেক মেয়র শফিক!

শেয়ার করুনঃ

অনলাইন ডেস্ক :: কখনো প্রকল্পের কাজ না করে, কখনো আংশিক করে রাজস্ব খাতের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। নিম্নমানের কাজ করে প্রকল্পের টাকা মেরে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ টাকা থেকে ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা করা হয়নি। বরং ওই টাকা উন্নয়নমূলক প্রকল্প দেখিয়ে লুট করা হয়েছে। মো. শফিকুল ইসলাম পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র পদে আট বছর দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম-দুর্নীতির এমন ফিরিস্তি উঠে এসেছে পত্রিকার অনুসন্ধানে।

দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় আজ রোববার পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধি এমরান হোসেন সোহেলের নামে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শফিকুল ইসলাম মেয়র নির্বাচিত হন ২০১০ সালে। মামলা জটিলতায় তিনি ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়ে পৌরসভার উন্নয়নমূলক কাজের বেশির ভাগই করেছেন তাঁর আপনজন হিসেবে পরিচিত গোলাম সরোয়ার বাদল।

শফিক মেয়র থাকাকালে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৌরসভার কাছে নথি চেয়েছে বলে জানা গেছে।

কাজ না করে টাকা লুট: পটুয়াখালী পৌরসভার জৈনকাঠী এলাকায় ‘টাউন জৈনকাঠী লিল্লাহ বোর্ড অ্যান্ড এতিমখানা থেকে ইছাক মডেল কলেজ পর্যন্ত আরসিসি নির্মাণ ও টাউন জৈনকাঠী চাষের খাল বক্স কালভার্ট থেকে ফুলতলা খালের উত্তর দিকের রাস্তাটি পুনর্নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। রাজস্ব তহবিলের এই প্রকল্পের অধীনে দুই হাজার ৬০০ মিটার আরসিসি রাস্তা নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় দুই কোটি ৩৮ লাখ ছয় হাজার ৬৪২ টাকা ৮৭ পয়সা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ পায় মেয়র শফিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত গোলাম সরোয়ার বাদলের প্রতিষ্ঠান পল্লী স্টোর্স। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। শুরুতে ৯০০ মিটার রাস্তার মাটির বেইস কেটে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই প্রকল্পে আর কাজ না করে পুরো টাকাই তুলে নেওয়া হয়।

এ ছাড়া একই প্রকল্পের ওপর বছরে একাধিক প্রকল্প দেখিয়ে পৌরসভার অর্থ লুটপাট করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।

ওই সূত্রে আরও জানা যায়, পটুয়াখালী মহিলা কলেজের সামনের রাস্তা থেকে ডোনাবান পর্যন্ত সড়ক উন্নয়নের জন্য এক বছরে একাধিক প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি তহবিলের কোটি কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে ওই রাস্তা উন্নয়নের জন্য ৯৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প দেখিয়ে পুরো টাকাই লুট করা হয়েছে। সূত্র মতে, কোনো কাজ না করেই পৌরসভার অন্তত ২২টি প্রকল্পের প্রায় ৫০ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে।

রডের পরিবর্তে বাঁশও দেওয়া হয়নি: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কলেজ রোডের বিএডিসি অফিস থেকে মেইন সবুজবাগ (শান্তিবাগ মোড় ও বায়তুল সালাম মসজিদ হয়ে) পর্যন্ত আরসিসি সড়ক (সরকারি কলেজের পেছনের সড়ক) নির্মাণের কথা। সে অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু কোনো রড ব্যবহার করা হয়নি।

এ ছাড়া ২ নম্বর বাঁধ চানমারী সড়কের কাছ থেকে দক্ষিণ সবুজবাগ এতিমখানার সামনের সড়ক (বড়বাড়ি মোহাম্মদ হারুন হাউস ও মসজিদ) পর্যন্ত আরসিসি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পেও একই ঘটনা ঘটেছে।

পৌরসভার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ দুটি সড়ক নির্মাণে প্রায় ২৮ লাখ টাকার রড ব্যবহারের কথা ছিল। কিন্তু দুটি সড়কের কোথাও রডের ব্যবহার হয়নি। এ সড়ক দুটিতে অনিয়ম শুধু রডের টাকা লুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নিয়মানুযায়ী পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর মেয়র কোনো বিলে স্বাক্ষর করতে পারবেন না বা তাঁর স্বাক্ষরে কোনো ঠিকাদারি কাজের অর্থ লেনদেন হবে না। কিন্তু চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও ২৪ জানুয়ারি ওই দুটি সড়কের কোটি টাকার বিলে সই করেছেন মেয়র।

পটুয়াখালীতে কর্মরত সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে বলেন, আরসিসি মানে হলো রি-ইনফোর্সমেন্ট সিমেন্ট কংক্রিট অর্থাৎ রড সিমেন্ট খোয়ার সঙ্গে পানি মিশ্রিত ঢালাই। রাস্তা তৈরিতে সিমেন্ট বালু খোয়ার ব্যবহার হলে অবশ্যই রডের ব্যবহার হতে হবে। এখানে রড হলো রাস্তার মেরুদণ্ড। রড ছাড়া এমন কাজ কেউ করে থাকলে পুরোটাই দুর্নীতি।

কাজ শেষ না হতেই বিল উত্তোলন: পটুয়াখালী শহরের পিডিএস মাঠের পূর্ব পাশে ২০১৫ সালে পৌর অডিটরিয়াম নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ছয় কোটি ৩৩ লাখ ১১ হাজার ১৬০ টাকা ৬৬ পয়সা। ২০১৭ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সিংহভাগ কাজ ফেলে রেখে ২৪ লাখ টাকা বাদে বাকি টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে। এ কাজের ঠিকাদার শফিকুর রহমান হলেও কাজটি করেছেন মেয়র শফিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বাদল।

ভ্যাট ও আয়করের টাকা লুট: পৌরসভার বিধান অনুযায়ী ঠিকাদারি কাজের ৭ শতাংশ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) এবং ৭ শতাংশ আয়কর ঠিকাদারের বিল পরিশোধের সময় কেটে রাখা হয়। তাৎক্ষণিক সেটা চালানের মাধ্যমে রাজস্ব বিভাগকে পরিশোধ করারও বিধান রয়েছে। কিন্তু শফিকুল ইসলামের মেয়াদে ওই নিয়ম মানা হয়নি। যে পরিমাণ ভ্যাট ও আয়কর কেটে রাখা হয়েছে তার সিংহভাগই পরিশোধ করা হয়নি। বরং ওই টাকা দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প দেখানো হয়েছে এবং ওই সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করে টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিদেশি বা দাতাদের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুধু ভ্যাট ও আয়কর সংশ্লিষ্ট বিভাগকে পরিশোধ করা হয়েছে। তবে রাজস্ব খাতের অর্থ বা জিওবির অর্থে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ভ্যাট ও আয়করের কোনো টাকাই জমা হয়নি মেয়র শফিকের মেয়াদকালে।

সূত্র দাবি করেছে, শুধু ভ্যাট ও আয়কর থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা জমা না দিয়ে লুটপাট করা হয়েছে।

বেতন-ভাতা ও বিদ্যুৎ বিল বকেয়া: সূত্রমতে, পটুয়াখালী পৌরসভায় বছরে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা আয় হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং বিদ্যুৎ বিলসহ যাবতীয় ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজন আট থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে আট কোটি টাকা। কিন্তু পটুয়াখালী পৌরসভায় মেয়র শফিকের সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা হয়নি। তাঁদের প্রায় এক বছরের বেতন-ভাতা বকেয়া রেখে যান শফিক। এ ছাড়াও পৌরসভার প্রায় পাঁচ কোটি ৭১ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে যান মেয়র শফিক।

পৌরসভার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুিবল এসব পরিশোধের পরও আমাদের আয় অনুযায়ী কোনো সংকট হয় না বরং উদ্বৃত্ত থাকে টাকা। অথচ সবই লুটপাট করা হয়েছে।’

রাস্তায় খানাখন্দ : আরসিসি সড়ক তৈরির পর ২০ বছর এবং কার্পেটিং সড়ক তৈরির পর তিন বছর কোনো মেরামত বা সংস্কার করা যাবে না—এমন বিধান থাকলেও নিম্নমানের কাজের কারণে পটুয়াখালী পৌরসভার নতুন তৈরি করা বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। পটুয়াখালী সার্কিট হাউসের সামনের আরসিসি সড়কটি দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে। ওই সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এখন সংস্কার প্রয়োজন। একই অবস্থা সদর রোডেরও।

তদন্ত করছে দুদক : মেয়র শফিকের সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদারকে। তাঁর স্বাক্ষরে দুটি চিঠি দিয়ে পৌরসভার কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, নথি চেয়ে প্রথম চিঠিটি দেওয়া হয় গত ১৩ অক্টোবর। আর দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠানো হয় ২২ অক্টোবর। প্রথম চিঠিতে ২০টি প্রকল্পের এবং দ্বিতীয় চিঠিতে ১২টি প্রকল্পের কাজের প্রাক্কলন, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি, শিডিউল বিক্রির তালিকা, প্রাপ্ত অর্থ জমা, দাখিলকৃত দরপত্র, ওপেনিং শিট, টেন্ডার কমিটি গঠন, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ ও অনুমোদন, চুক্তিপত্র, কার্যাদেশ, বিল সংশ্লিষ্ট নথিপত্র, প্রকল্পের কাজের বিপরীতে দেওয়া বিল থেকে কর্তনকৃত ভ্যাট ও আয়করের পরিমাণসংবলিত তালিকা এবং ওই টাকা চালানের মাধ্যমে জমাকরণের সত্যায়িত কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে।