‘করোনা দিছে ঘরে আটকাইয়া, বানে দিছে রাস্তায় উঠাইয়া’

শেয়ার করুনঃ

‘করোনার ডরে গত তিন মাস বাইরে কাজকাম করতে পারি নাই। ঘরের মধ্যে আটকা ছিলাম। ধারদেনা করে ও সরকারি রিলিফ খেয়ে কোনোরকম পোলাপান লইয়া বাঁইচা ছিলাম। তারপরও কোনো কোনো সময় মনে ডর লইয়া অন্যের বাড়িতে পলাইয়া কাজ কইরা কিছু আয় করতাম। সাতদিন ধইরা এলাকার সবার বাড়িঘর বন্যার পানিতে ভাইসা গেছে। আমার ঘরের মধ্যে পানি হওয়ায় ঘরের সবাই বেড়িবাঁধে উঠেছি। বছরটা বালা-মছিবতের মধ্যে খুব কষ্টে যাচ্ছে। করোনা দিছিল ঘরে আটকাইয়া, এহোন আবার বানে দিছে রাস্তায় উঠাইয়া। এই মেঘ বৃষ্টি ও বানের মধ্যে বাড়ির হাস-মুরগি গরু-ছাগল শিশু পোলাপান ও বুইড়া লইয়া রাস্তায় থাকার কষ্ট কেউরে বুঝাইতে পারুম না।’

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়নের বেপারী ডাঙ্গী গ্রামের বেড়িবাঁধ সড়কে আশ্রিত বন্যাদুর্গত সরোয়ার বেপারী (৬০) মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) দুপুরে পরিবারের কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন।

সরোয়ার বেপারী জানান, চরহরিরামপুর ইউনিয়নে তার আদি বসতি ছিল। পদ্মা নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার পর গত কয়েক বছর ধরে বেপারী ডাঙ্গী গ্রামের ফসলি মাঠের মধ্যে এক টুকরা জমিতে বাড়ি করে দিনমজুরের কাজ করতেন। সাতদিন আগে বন্যার পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়িবাঁধ সড়কে উঠেছেন। বাঁশের খুঁটি ও পলিথিনের চাল দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। রাস্তার পাশে গরু-ছাগল রেখেছেন। তার সংসারে তিন শিশু ছেলে, স্ত্রী, বৃদ্ধ মা রয়েছে। এসব কিছু নিয়ে বেড়িবাঁধ সড়কের ওপর দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

Faridpur-badh-(4).jpg

একই গ্রামের চম্পা বেগম (৪৫) বলেন, আমার স্বামী বৃদ্ধ। কাজ করতে পারেন না। তাই অর্থাভাবে বেড়িবাঁধ সড়কে আশ্রয় নিতে পারিনি। বন্যায় বাড়িতে থাকতে না পেরে শুধু গরু-ছাগল রাস্তায় রেখে পরিবারের সবাই প্রতিবেশী ইছাহাক মাস্টারের বাড়ির একটি পরিত্যক্ত ঘরে বসবাস করছি।

জানা যায়, উপজেলার বন্যা প্রতিরোধক ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সড়ক রয়েছে। উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়ন ছাড়াও চরহরিরামপুর ইউনিয়নের ইন্তাজ মোল্যার ডাঙ্গী গ্রাম ও আরজখার ডাঙ্গী গ্রামের বেড়িবাঁধে এবং সদর ইউনিয়নের টিলারচর, এমপি ডাঙ্গী, ফাজেলখার ডাঙ্গী ও বালিয়া ডাঙ্গী গ্রামের বেড়িবাঁধ সড়কে বন্যাদুর্গত শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

গাজিরটেক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুর রউফ বলেন, পদ্মা নদীর পার এলাকা ঘেঁষে বেড়িবাঁধগুলোর মধ্যে বেপারী ডাঙ্গী গ্রামের বেড়িবাঁধ, চরহোসেনপুর গ্রাম মধু ফকিরের ডাঙ্গী গ্রাম ও জয়দেব সরকারের ডাঙ্গী গ্রামের বেড়িবাঁধে গত সপ্তাহে অন্তত ৯০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে প্রতি বরাদ্দে মেম্বারদের খুব অল্প সংখ্যক পরিবারের বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে সবাইকে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হয় না।

Faridpur-badh-(4).jpg

গাজীরটেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইয়াকুব আলী বলেন, বেড়িবাঁধে আশ্রিত পরিবারের জন্য এখনও সুনির্দিষ্টভাবে ত্রাণ সামগ্রী প্রদান করার সুযোগ হয়নি। মঙ্গলবার জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. আব্দুস সোবাহান সরেজমিনে ইউনিয়নের বিভিন্ন পানিবন্দি পরিবার পরিদর্শন করেন এবং ১০৫ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেছেন।

চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে যেসব ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয় তার মধ্যে বেড়িবাঁধ সড়কে আশ্রিত পরিবারের জন্য চেয়ারম্যান ও মেম্বাররাই তালিকা করে দেন। সেভাবেই ত্রাণ দেয়া হয়। বন্যাকবলিত প্রতিটি ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, ফরিদপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ফরিদপুরে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ১১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫৪১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় পানিবন্দি হয়েছেন দেড় লক্ষাধিক মানুষ। পানি বৃদ্ধির ফলে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় পানি প্রবেশ করছে।

সোমবার (২৭ জুলাই) বিকেল ৪টার দিকে ফরিদপুর শহররক্ষা বাঁধে আবারও ভাঙন দেখা দিয়েছে। ধসে গেছে ৪৫ মিটার অংশ। বাঁধের ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

ফরিদপুর সদর উপজেলার আলীয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আলিয়াবাদ ইউনিয়নের সাদীপুরের বিল গজারিয়া এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের শহররক্ষা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪৫ মিটার অংশ ধসে গেছে। বাঁধের ওই অংশ ভেঙে যাওয়ার ফলে তীব্র বেগে ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

Faridpur-badh-(2).jpg

বাঁধের ওই অংশে গত ১৯ জুলাই ৮০ মিটার ভেঙে যায়। বালুভর্তি জিওব্যাগ দিয়ে সেই ফাটল বন্ধ করা হয়। সেই জায়গায় আবারও ৪৫ মিটার অংশ পানির তোড়ে ভেঙে যায়।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, প্রকৃতির শক্তির কাছে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। গত ১৯ জুলাই থেকে কাজ করেও বাঁধটি টিকিয়ে রাখতে পারিনি। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজাইন বিভাগকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাদের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, জেলার সাত উপজেলা বন্যাকবলিত। তার মধ্যে সদর, সদরপুর ও চরভদ্রাসন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মোট ৫১৯ গ্রামের ৩৮ হাজার ৩৬৯টি পরিবারের এক লাখ ৭২ হাজার ৬৬১ জন মানুষ বন্যাকবলিত। ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন সবাই অবস্থান করে সে কারণে বেশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৬৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ পাঁচ লাখ টাকা, দুই হাজার ৬০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও পর্যাপ্ত শিশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।