ইউএনওর ওপর হামলা : ভিডিওর সঙ্গে মিলছে রবিউলের বক্তব্য

শেয়ার করুনঃ

অনলাইন ডেস্ক :: দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী শেখের ওপর হামলায় অভিযুক্ত সাবেক মালি রবিউল ইসলাম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ভুল করে আক্রোশের বসে এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।

রবিউলকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে সেই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। রবিউলের বক্তব্য, ভিডিও ফুটেজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য সব কিছুই মিলে যাওয়ায় পুলিশ বিষয়টি নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত এই ঘটনার সঙ্গে একজনই জড়িত। তার দেয়া তথ্যমতে আলমারির চাবি, হাতুড়িসহ বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে যা বলেছে রবিউল

অর্থকষ্ট আর চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়ায় মানসিকভাবে অশান্তিতে ছিলেন রবিউল। পরিকল্পনা করেই নিজ বাড়ি দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার বিজোড়া গ্রাম থেকে বিকেল ৪টার দিকে ঘোড়াঘাটে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হন রবিউল। দিনাজপুর ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি যাত্রীবাহী গাড়িতে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঘোড়াঘাটে পৌঁছেন তিনি। এরপর ঘোড়াঘাট বাজারের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে রাত ১টার দিকে ইউএনওর বাসভবনের প্রাচীর টপকে ভেতরে প্রবেশ করেন রবিউল। ওই সময় ইউএনওর বাসভবনের চারদিকে নীরবতা ছিল।

রবিউল দাবি করেন- প্রথমে নৈশপ্রহরী নাদিম হোসেন পলাশের কক্ষে যান তিনি। তখন পলাশ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন। তার কক্ষে ইউএনওর বাসভবনের কেঁচিগেট ও প্রধান ফটকের তালার চাবি খুঁজতে থাকেন। চাবি না পাওয়ায় পলাশের কক্ষ থেকে বের হয়ে পরিত্যক্ত কাঠ রাখার ঘরের কাছে গিয়ে একটি চেয়ার ও মই নিয়ে ইউএনওর বেডরুমে নৃশংস কায়দায় হামলার পরিকল্পনা করেন। রবিউল ওখানে মালি পদে চাকরি করার সময় মই দিয়েই ইউএনওর সরকারি বাসভবনে কবুতরের বাসা পরিষ্কার করতেন।

পরিকল্পনা মোতাবেক ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার জন্য মই সেট করেন রবিউল। তবে মই দিয়ে ওয়াল বেয়ে ভেন্টিলেটর খুলে ভেতরে প্রবেশ করে তিনি দেখেন- যেখানে প্রবেশ করেছেন সেটি বেডরুম নয়, বাথরুম। আর সেই বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে লাগানো। তাই ওই সময় ইউএনওর ঘুমের কক্ষে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। রবিউল অপেক্ষা করতে থাকেন ইউএনও কখন বাথরুমে প্রবেশ করবেন। এরই মধ্যে রবিউল বাথরুমের ভেতর থেকে দরজা আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে থাকেন। প্রায় ৩০ মিনিট বাথরুমের ভেতরে ছিলেন তিনি।

ধীরে ধীরে ধাক্কার পর বাথরুমের দরজা খুলে যায়। রাত সাড়ে ৩টার দিকে ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হন তিনি। রুমে প্রবেশ করার সময় একটি শব্দ হয়। এটা ইউএনও ওয়াহিদা টের পেয়ে যান। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় ওয়াহিদা তার বাবাকে বলেন, ‘দেখো তো কোন বেয়াদব রুমে ঢুকেছে।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ইউএনও ওয়াহিদা বিছানা থেকে উঠতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার গালে ও মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন রবিউল। একপর্যায়ে ইউএনও বিছানায় ঢলে পড়েন। তার চিৎকারে পাশের রুম থেকে তার বাবা ওমর আলী শেখ এগিয়ে আসামাত্রই তাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেন রবিউল। দরজার চৌকাঠের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় তার বাবাও পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছিলেন না।

এ সময় কেন তার মেয়ের ওপর হামলা করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের পাশাপাশি প্রহরী নাদিম হোসেন পলাশকে একাধিকবার ডাক দেন ইউএনওর বাবা। এদিকে রবিউল একপর্যায়ে আলমারির চাবির কথা বললে ওমর আলী শেখ চাবি রাখার স্থান বলে দেন। ওই চাবি নিয়ে ঘর থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন রবিউল। সাড়ে ৪টার দিকে বের হয়ে যান তিনি। প্রাচীর টপকে রাস্তা দিয়ে সোজা মহাসড়কে যান তিনি। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা কোচে উঠে দিনাজপুরে চলে যান রবিউল। বাসায় ফিরে সকালের নাশতা খেয়ে ডিসি অফিসের নাজিরের কাছে যান তিনি। সব কিছু স্বাভাবিকভাবে করছিলেন রবিউল।

সূত্র জানায়, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে রবিউল ইউএনওর বাসায় ঢোকার সময় একটি লাঠি তার হাতে ছিল। রবিউল দাবি করেন, ইউএনওর কার্যালয়ের আশপাশে অনেক কুকুর রয়েছে। কুকুর তেড়ে এলে যাতে লাঠি দিয়ে পেটাতে পারেন তাই সঙ্গে লাঠি রেখেছিলেন তিনি।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও রবিউল জানান, চার মাস আগে ইউএনওর ব্যাগ থেকে ১৬ হাজার টাকা চুরি হয়। ওই টাকা পরে তাকে ফেরত দিতে হয়। এ ঘটনায় যাতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয়, সে ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন ইউএনওকে। এরপরও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং বিভাগীয় মামলা করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর তিনি ১৭ হাজার টাকা বেতনের স্থলে ৯ হাজার টাকা করে পাচ্ছিলেন। এটা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল তার। তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আবার জুয়া খেলেও অনেক টাকা ঋণ হয় তার। এরপরই পরিকল্পনা করেন ইউএনওর ওপর হামলা করবেন।

রবিউল জানান, ইউএনওর ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করার কিছুদিন পর তার বাসায় গিয়ে ইউএনও এবং তার বাবার কাছে ক্ষমা চান তিনি। তবে তারা ক্ষমা করেননি। এ নিয়ে তার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

রবিউল পুলিশকে জানান, ইউএনও ও তার বাবার ওপর হামলার পর ওই বাসা থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি করে দিনাজপুরের বিরলের জনৈক খোকনের হাতে দেন। খোকন ক্রিকেট জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় মামলায় সাক্ষী হিসেবে খোকনের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও জুয়ার সঙ্গে জড়িত থাকায় খোকনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

এদিকে রবিউল ইসলামই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত- পুলিশের এমন দাবির বিষয়ে কাজ করছে অন্য একটি সংস্থা। তারা এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখছে।

সংস্থাটির এক কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনাটির যাবতীয় তথ্য, সিসি ফুটেজ ও আলামতসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছেন বেশ কিছু কর্মকর্তা। ঘটনাটি পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি আলাদাভাবে দেখছেন তারা। যাতে করে মামলার মোড় অন্য কোনো দিকে যেতে না পারে সেজন্য সার্বক্ষণিক কাজ করছেন তারা। তাই র্যাব ও পুলিশের বক্তব্য যাই হোক সেটি নিয়ে বিচলিত নন তারা।

এক কর্মকর্তা জানান, র্যাব, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের প্রতি তাদের আস্থা আছে এরপরও যোগসূত্রগুলো মিলিয়ে দেখছেন তারা। ওই রাতে যারা হামলা চালিয়েছিল তারা আলমারির চাবি চাচ্ছিল বলে জানা গেছে। হামলা যদি আক্রোশে হয় তাহলে আলমারির চাবি নেয়ার উদ্দেশ্য কি সেটি বিবেচনায় রেখে কাজ করছেন তারা।

এর আগে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেছিলেন, ঘটনার দিন রাত ১টা ১৮ মিনিট থেকে ৪টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত একজন ব্যক্তি সেই বাড়িতে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে ওই ব্যক্তি একবার বাড়ি থেকে বের হয়ে আবারও বাড়িতে প্রবেশ করেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে লাল টি-শার্ট বা জামা পরিহিত এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার করার দৃশ্যও রয়েছে।